• বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

সনদ ও গণভোট : ‘জাতীয় ঐকমত্য’, নাকি বুর্জোয়া দরাদরি, কোন্দল ও ভাঙন

সনদ ও গণভোট : ‘জাতীয় ঐকমত্য’, নাকি বুর্জোয়া দরাদরি, কোন্দল ও ভাঙন

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

বৃহঃস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫  |  অনলাইন সংস্করণ

ভূমিকা 

ওরা একে বলছে “জাতীয় জুলাই সনদ”। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট স্মরণীয় হাসিনা-বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের কারণে। এ অভ্যুত্থানের সুদীর্ঘ ১৫ মাস পরে এই সনদটি ঘোষিত হলো ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর। ড.ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার” রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন” গঠন করেছিল ফেব্রুয়ারিতে। গঠনের পর এ কমিশন নয় মাস পর এ সনদটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর গ্রহণ করে তা প্রকাশ করেছে।

এটি জাতীয় ঐকমত্য নয়

ক্ষমতাসীন তৃতীয় শক্তি, বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল ও তাদের লেজুড় ছোটো দলগুলো দাবি করছে এটি জাতীয় ঐকমত্য। কিন্তু খোলা চোখেই দেখা যাবে যে, এটি সমগ্র জাতির ঐকমত্য নয়। প্রথমত, এ তথাকথিত ঐকমত্যের আলোচনায় ৩৮টি দল/জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৩২টি দল, শেষে ৩০টি দল/জোট অংশ নেয়। কীভাবে দাবি করা যায় যে, এ ধরনের ৩০টি দল সমগ্র জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে? গুটিকয় বড় বুর্জোয়া দল ছাড়া বাকী প্রায় বিশ/পঁচিশটি দল/জোটের কার্যত কোনো গণ-ভিত্তি বা সংগঠনই নেই। তাদের নামও অংশগ্রহণকারী অনেকে বলতে পারবেন না। বিশেষত, জনগণের সবচেয়ে সংখ্যাগুরু অংশ শ্রমিক ও কৃষক, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ আদিবাসী, নারী, ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী– এদের শ্রেণি/পেশা/সম্প্রদায়গত কোনো প্রতিনিধিত্বই এই দরাদরিতে ছিল না। জাতি কি শুধু কিছু বুর্জোয়া দল, কিছু এনজিও আর বুদ্ধিজীবী নেতারা?

দ্বিতীয়ত, অংশগ্রহণকারী বাম নামধারী দলগুলোর একাংশ (সিপিবি, বাসদসহ ৪টি দল) তাদের নীতিগত কারণে (রাজনৈতিক) শেষ পর্যন্ত এতে স্বাক্ষর করেনি। এ পার্টিগুলো বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী, তাদের অনুসারী বুদ্ধিজীবী ও জনগণের বেশ কিছু অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।

তৃতীয়ত, তৃতীয় শক্তির একাংশের আশীর্বাদধন্য কিংস পার্টি এনসিপিও স্বাক্ষর করেনি, সনদের আইনগত ভিত্তি এতে না থাকায়। অবশ্য তারা বলছে সনদের সাথে তারা একমত।

চতুর্থত, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা স্বাক্ষর করেছে তাদের মাঝে মৌলিক কিছু জায়গায় গুরুতর দ্বিমত রয়েছে, যাতে তারা “নোট অব ডিসেন্ট” দিয়েছে। প্রধান বুর্জোয়া পার্টি বিএনপি এ ধরনের সবচেয়ে বেশি দ্বিমত জানিয়েছে। পঞ্চমত, হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হলেও আওয়ামী রাজনীতির অনুগত (বুঝে বা না বুঝে) বহু জনগণ দেশে রয়েছেন। চলমান বুর্জোয়া রাজনীতি তাদেরকে বাতিল করতে পারে না, কারণ, জুলাই-আগস্টে কোনো বিপ্লব ঘটেনি, ক্ষমতাসীনরাও এসব পার্টিকে এখনো পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেনি। অথচ তাদের ও তাদের মিত্র (যেমন জাতীয় পার্টি)-দেরকে আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হলেও জাতীয় পার্টি ও অন্য আওয়ামী মিত্র পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে সেটাও করা হয়নি। তাহলে তাদেরকে বাইরে রেখে বুর্জোয়া অর্থেও “জাতীয় ঐকমত্য” হয় কী করে?

এসব সত্ত্বেও একে বলা হচ্ছে “জাতীয় ঐকমত্য”। এটা কি এদের মূর্খতা, না জনগণের সাথে প্রতারণা?

সনদ দলিলের কিছু পরিচিতি 

দলিলটিতে মোট ৫টি অধ্যায় রয়েছে, আর শেষে রয়েছে স্বাক্ষরকারীদের অঙ্গীকারনামা। প্রথম চারটি ছোটো পরিচিতিমূলক ও ভূমিকা সম্বলিত অধ্যায় বাদে প্রধান ও বিস্তৃত অধ্যায়টির শিরোনাম হলো “ঐকমত্যে উপনীত হওয়া বিষয়সমূহ”। অধ্যায়ের এমন শিরোনামও প্রতারণামূলক। কারণ, এতে মোট ১৩টি উপ-অধ্যায়ের মোট ৮৪টি ধারায় অনেক ঐকমত্য ছাড়াও বহু বিষয়ে বিভিন্ন পার্টির খুচরা ও গুরুতর ভিন্নমতও রয়েছে, যা নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে।

যে মোট ৮৪টি ধারা এখানে উত্থাপিত হয়েছে তাতে ১নং থেকে ৮নং ধারাগুলো বাদে বাকী সবই প্রায় শাসকদের শাসন-ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত পরিবর্তনের বিষয়।

এসব ধারার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তার অধীনে নির্বাচন তথা নির্বাচনি ব্যবস্থা, বুর্জোয়া নারীদের প্রচলিত রাষ্ট্র-ক্ষমতায় ভাগ বাড়ানো, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া ক্ষমতা হ্রাস, উচ্চকক্ষ ও তাতে পিআর– ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব সংস্কারের উপরও অনেক কথা নিশ্চয়ই বলা যায়। কিন্তু সেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এসব নিয়েই বুর্জোয়া দলগুলো ও তৃতীয় শক্তির প্রতিনিধিরা সভার পর সভা করেছে (প্রথম পর্বে ৪৭টি ও দ্বিতীয় পর্বে আরো কয়েকটি), তর্ক করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তারপরও সব প্রশ্নে ঐক্য করতে পারেনি। ক্ষমতার কেন্দ্রে কিংস পার্টিটিকে এখন কিছুটা প্রান্তিক করে দেয়ায় তারা প্রায়ই গোস্বা করছে, তারা সনদ-অনুষ্ঠানও বর্জন করেছে। স্পষ্টতই তাদের নেতৃত্বে ও মদদে এমন একটি রাষ্ট্রীয় “পবিত্র” অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য জুলাই-যোদ্ধা নামে কিছু মানুষকে উস্কে দেয়ার কাজও তারা করেছে। পরে অবশ্য তাদেরকে অন্য সবাই বাবা-গো সোনা-গো বলে স্বাক্ষরে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাহোক, বুর্জোয়া শাসনের পদ্ধতিগত বিষয়ে বেশি কথা না বাড়িয়ে সনদের প্রথমে উল্লেখিত সাংবিধানিক সংস্কারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক প্রশ্নেই আমরা কিছুটা আলোচনা করবো। কারণ, এটাই, কিছুটা হলেও, এত সব আয়োজনের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সনদ হলো বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির “তৃতীয় শক্তি”র রাজনীতি ও আপস-ফর্মূলা

 বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির হাসিনা-বিরোধী অংশগুলোর আপাত ঐক্য ও কোন্দলের দলিল   

একে বলা হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য, ইউনূস বলেছেন এটা জাতি/দেশকে বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এনে দিয়েছে, শুধু দেশ নয় সারা পৃথিবীর জন্য এটা এক অসাধারণ বিষয়– ইত্যাদি। বাস্তবে দেখা যাক এটা কী? এত ঢাক-ঢোল পেটানো একটি সনদ, যাকে তৈরি করার জন্য একজন বাঙালি চামড়ার আমেরিকান নাগরিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে উড়িয়ে আনা হয়েছে, তাতে শ্রমিকের জন্য কী “নতুন বন্দোবস্ত” রয়েছে? কৃষকের জন্য? আদিবাসীর জন্য? নারীদের জন্য?

এতে কি সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে একটিমাত্র শব্দও রয়েছে? ভারতের বিরুদ্ধে এত-যে জেহাদ, কোরানের শাসন-পন্থিরা সহ, তথাকথিত জেন-জি’র তরুণ প্রজন্মের যারা এই সনদের বড় উদ্যোক্তা তারাসহ, সেই ভারত সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?

বুর্জোয়া দল বাদ দিলাম, তথাকথিত বাম দলগুলো, যাদের একাংশ “নতুন বন্দোবস্ত”-র নামে হরদম টিভি চ্যানেলগুলো গরম করে রাখে, তারা কি এসব বিষয় সনদে আনার জন্য কোনো সংগ্রাম করেছে?

এসব কিছুই নেই। আগেই আমরা বলেছি, বিভিন্ন শ্রেণি/পেশা/সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিকেই এখানে ডাকা হয়নি। ডাকা যদি হতোও, তাতেও তারা এসব জনগণের বুর্জোয়া প্রতিনিধিই হতো। কিন্তু তাও-তো ডাকা হয়নি।

যে তরুণ শিক্ষার্থী ও তথাকথিত জেন-জিদের প্রতিনিধি বলে দাবি করা নতুন দলটি জন্ম নিয়েছে “বৈষম্যবিরোধী” ছাত্র-আন্দোলনের একাংশ থেকে, তারা কি সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রে বাদ দিন, শুধুমাত্র শিক্ষায় বৈষম্য অবসানের জন্য কোনো বিষয় এনেছে এখানে?

নারীদের মৌলিক সমস্যার উপর কোনো কথা না বলে, বা পুরোনো “বন্দোবস্ত” রেখে দিয়ে তারা কিছু বেশি সংখ্যায় বুর্জোয়া নারীদের এমপি হবার পথ খোলাসা করেছে মাত্র। এটা নারী এনজিও কর্মকর্তাদের জন্য একটি সুবাতাস বটে, কিন্তু আপামর নারীদের ক্ষেত্রে এর কী ফল থাকতে পারে?

এসবের মূল কারণ হলো, এ দলিল পেশ করেছে ও পাশ করিয়েছে বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির তথাকথিত তৃতীয় শক্তিটি, যারা অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করেছে, অভ্যুত্থানে পেটি-বুর্জোয়া ও বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বদের ষড়যন্ত্র ও দেউলিয়াপনার কারণে। যেহেতু তারা দীর্ঘবছর ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না বুঝে গেছে, তাই তারা তাদের কিছু স্বাস্থ্য-বটিকা বুর্জোয়া রাজনীতিকে খাইয়ে দেবার চেষ্টাতেই এ সনদটি করেছে।  এটা দিয়ে নাকি ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদ প্রতিহত হবে। কোন বোকার স্বর্গে তারা বাস করছে? এ সনদ তৈরির কারিগরদের মধ্যেই তো রয়েছে এদেশের শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিস্ট ’৭১-এর রাজাকারের উত্তরসূরী জামাতসহ ধর্মবাদী দলসমূহ। রয়েছে বিরাজনীতিকরণের কুশিলব তৃতীয় শক্তির গোপন ও প্রকাশ্য ভূমিকা। কীভাবে এটা ফ্যাসিবাদকে ঠেকাবে?

সংবিধানের মূল নীতি 

সনদে প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হলো সাংবিধানিক সংস্কার, বিশেষত তার মূল নীতি বিষয়ক পরিবর্তন। সংবিধানের মৌল নীতি আগে ছিল (’৭২-এর সংবিধানে) চারটিÑ যথা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এটা যা-ও কিছুটা ছিল সেটাও উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মৌলিক এ কারণেই ৪টি বামপন্থি দল সনদে স্বাক্ষর করেনি।  আমরা ’৭২-সংবিধানকে সমর্থন করি না, তাই এই চার মূল নীতির কাগুজে উল্লেখ প্রশ্নে আমাদের কোনো প্রেম নেই। কিন্তু এটা তো দেখানো অন্যায় নয় যে, চলমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে তার মূল নীতিকে এরা বাতিল করে কোন ক্ষমতায়? এই স্ববিরোধকে ও প্রতারণামূলক কাজকে ন্যায্য করার জন্য তারা গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ– ইত্যাদির সুর তুলেছে। আর এসব নিয়ে তাদের মাঝে পুনরায় কোন্দল ও খেয়োখেয়ি বেধে গেছে।

’৭২-সংবিধানের মূলনীতি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কী দিয়ে? তারা বলছে “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার”। এসব কথা তারা কোথায় পেয়েছে? পেয়েছে ’৭১-সালে ১০ এপ্রিল গঠিত তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের ভাষণ থেকে। এদেশে অনেকেই রয়েছেন যারা শেখ মুজিবকে বাতিল করতে গিয়ে তাজউদ্দিনকে তুলে ধরেন; ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানকে ও ’৭২-সংবিধানকে বাতিল করতে চান তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। কিন্তু এটা-যে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ভারত-আওয়ামী বয়ানেরই একটি রকমফের সেটা তারা মাটিচাপা দেন। দেশে বহু আন্তরিক বামপন্থি, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীও এমন বয়ান দেন।

প্রথমত, উপরোক্ত নীতি ’৭১-মুক্তিযুদ্ধ কালে ভারতে গঠিত, ভারত দ্বারা সৃষ্ট, আওয়ামী প্রবাসী সরকারেরই একটা ভাষণ, যা তাজউদ্দিন আগরতলায় সরকার গঠনের পর তার ১১ এপ্রিলের ভাষণে দিয়েছিলেন। আমরা ’৭২-সংবিধানকে উচ্চে তুলতে চাই না, কিন্তু এটা তো সত্য যে এ সংবিধান রচনা করেছিল অন্ততপক্ষে বাংলাদেশি লোকেরা এ দেশে বসেই। অন্যদিকে তাজউদ্দিনের ভাষণটি দেয়া হয়েছিল ভারতের মদদে গঠিত ভারতের প্রত্যক্ষ পরামর্শে প্রত্যক্ষভাবে ভারত-পরিচালিত প্রবাসী সরকারের নামে ভারতের বেতার থেকে। একে মহিমান্বিত করার অর্থ হলো ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের উঠতি বুর্জোয়ার ভারত-নতজানু নীতিকেই মেনে নেয়া।

দ্বিতীয়ত, এসব নীতি একেবারেই বিমূর্ত। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা ছিল অষ্টাদশ শতকে মহান ফরাসী বিপ্লবের স্লোগান। সেটা তখন বুর্জোয়া বিপ্লবকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। যদিও পরবর্তী একশ বছরের কম সময়ের মধ্যেই এসবের ফঁাকা চরিত্র প্রমাণিত হয় এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র বিশ্ব-রাজনীতির প্রগতিশীল চরিত্রকে প্রকাশ করতে থাকে। সনদে যা এসেছে তা পুরোনো ও বাতিল হয়ে যাওয়া বুর্জোয়া বিমূর্ত বাক্যবিন্যাস মাত্র।

’৭২-এর সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটির সংযোজন মুজিব-আওয়ামী লীগের কোনো সমাজতন্ত্র প্রেম থেকে ঘটেনি, ঘটেছিল তৎকালে সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার মুখে জনগণকে প্রতারণা করার জন্য। কিন্তু সমাজতন্ত্র শব্দটি সাম্যের চেয়ে অনেক বেশি মূর্ত। তাকে বাদ করে সাম্য....... যোগ করা হলো প্রতারণা তো বটেই, ঐ সংবিধানের থেকেও দু’পা পিছিয়ে যাওয়া। একই কথা বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে। শব্দটি বাংলায় খুব যথার্থ না হলেও সেটা একটা প্রগতিশীলতার স্বীকৃতি বটে, যদিও এটাও পরে আওয়ামীদের একটা শয়তানি প্রতারণায় পরিণত হয়। তার বদলে আনা হয়েছে “ধর্মীয় স্বাধীনতা”। ধর্মীয় স্বাধীনতা জনগণের থাকতে হবে, কিন্তু এটা দ্বারা রাষ্ট্র যে ধর্ম-বিযুক্ত হবে তাকে আরো বেশি অস্পষ্ট করা হয়। সেকারণেই দেখা যাবে এতবড় ঢাক-ঢোলের সংস্কারে সংবিধানে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদ কর্তৃক ধর্ম ব্যবহার করার অপস্বার্থে যুক্ত করা “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম”কে স্পর্শ পর্যন্ত করা হয়নি। এটা-তো এরশাদ-হাসিনা-খালেদা-জামাত-ধর্মবাদী স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্টদের একই বন্দোবস্তের পথে চলা।

আগে বলা হয়েছিল দেশের জনগণ জাতি হিসেবে “বাঙালি”। এই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাতিল করাটা ভালো। কিন্তু এর বদলে বিভিন্ন জাতির জনগণের জাতি পরিচয়টিকেই উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা নতুন ধরনের প্রতারণা ব্যতীত আর কিছু নয়।

অথচ এর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা রূপে আগের মতোই বাংলা-কে রাখা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অন্য জাতিগুলোর ভাষাগুলোকে অমর্যাদা করা হয়েছে। একটি একক রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা হাসিনার মতোই উগ্র-জাতীয়তাবাদের পথ করে দেয়। ইতিহাস বর্ণনায় ’৪৭-সালের পাকিস্তান সৃষ্টিকে কূট-কৌশলে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে, আবার ’৭১-এর আওয়ামী-ভারতের মুক্তিযুদ্ধ বয়ানকে রাখা হয়েছে। একদিকে এটা ঘোরতর স্ববিরোধিতা, অন্যদিকে দেশের আধুনিক ইতিহাসে বড় বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের একই রাজনৈতিক অবস্থানকে কিছু পরিবর্তিত রূপে তুলে ধরা। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস বর্ণনায় আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হত্যা-নিপীড়নকে বিরোধিতার আড়ালে চরম পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল দাবির ভিত্তিতে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের সমাবেশকে তুলে ধরা ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদের পথ করে দেয়ার নিন্দনীয় সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়।   গণভোট প্রশ্নে জনগণের সাথে প্রতারণা আগেই আমরা বলেছি যে, সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নে নিজেদের স্ববিরোধিতাকে আড়াল করার জন্য সনদকে গণভোটে দেয়ার একটি প্রস্তাব আলোচনা হচ্ছে। যদিও সেটা সংসদ নির্বাচনের আগে হবে না একসাথে হবে তা নিয়ে কোন্দল চলমান। যার সুযোগ নিতে চাচ্ছে তৃতীয় শক্তির সেই অংশ যারা নির্বাচন চাচ্ছে না এবং নিজেদের ফাও ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। গণভোট হয়ে থাকে একটিমাত্র প্রশ্নে, যাকে জনগণ হ্যাঁ-না ভোট হিসেবে জানেন। সনদ একটিমাত্র বিষয় নয়। এতে ৮৪টি ধারা রয়েছে। বহু বিষয়ে প্রধান বুর্জোয়া পার্টি বিএনপিসহ অনেকের দ্বিমতও রয়েছে। কীভাবে এই জটিল বিষয়টিকে হ্যাঁ বা না ভোট দিয়ে জনগণ মতামত দেবেন? গুরুতর বিষয়টি হলো, চলমান সংবিধানে গণভোটের বিষয়টিই নেই। তাহলে কীভাবে সংবিধানকে যারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার শপথ নিয়েছে তাদের পক্ষে গণভোট করা সম্ভব? ধরলাম তারা জোড়াতালি দিয়েই চালাতে চায়। কিন্তু গণভোটে মোট ভোটারের অর্ধেকের কম ভোট পড়লে? যার সম্ভাবনা খুবই রয়েছে, কারণ জনগণের কোনো ঠ্যাকা পড়েনি এ জাতীয় ভোটে অংশ নেবার। অথবা প্রদত্ত ভোটের অধিকাংশ যদি ‘না’ ভোট পড়ে? তাহলে কি তারাই প্রমাণ করবে না যে, অভ্যুত্থানটি অন্যায় ছিল এবং জনগণ তার বিরুদ্ধে? এমন পদক্ষেপে যাবার পেছনে ষড়যন্ত্র থাকা কি অস্বাভাবিক?

যারা সনদে স্বাক্ষর করেছেন তারাই বা কীভাবে তাদের দ্বিমতগুলোকে বাস্তবায়ন করবেন?

 

সনদে নব্য-ফ্যাসিবাদের সুর 

সনদে যারা কিছু বিষয়ে দ্বিমত করেছেন তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু সনদের শেষে অঙ্গীকারনামায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, তারা এ সনদ “পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত” করবে। এটা তো ভিন্নমতকে স্বীকার করেও জোর করে তৃতীয় শক্তির মতামতকে গিলিয়ে দেয়া। বিএনপিসহ ডিসেন্ট দেয়া পার্টিগুলো কীভাবে এটা মেনে নেয়? তারা কি সজ্ঞানে ফ্যাসিবাদী নীতিকে স্বীকার করে নিচ্ছেন না?

আবার বলা হয়েছে সনদের কোনো বিষয়ে আপত্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। এর অর্থ হলো, ভিন্নমতকে অঙ্কুরেই মেরে ফেলা। এটাও কি নব্য-ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি নয়? একদিকে তারা বলছে জনগণের অভিপ্রায় হলো সবচেয়ে বড় আইন, অন্যদিকে বলছে জনগণ তার অভিপ্রায় নিয়ে আদালতে যেতে পারবে না। এটা বিচার চাওয়ার প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকারকেই পদদলিত করে।

বলা হয়েছে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সনদে উল্লিখিত নীতি/মতই প্রাধান্য পাবে। এটা কি সংবিধানের নামে আরেকটি প্রতারণা ও ফ্যাসিবাদী বক্তব্য নয়?

শেষ কথা 

নির্বাচন হবে কিনা তা অনিশ্চিত। কারণ, সবাই জানে ও অনেকেই বলছে যে, ষড়যন্ত্র চলছে। তৃতীয় শক্তির অনেকেই নির্বাচন চায় না। ড.ইউনূস যদিও জোর গলায় দেশে ও বিদেশে বলে চলেছেন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। যত অনিশ্চিত, তত জোর গলা। কে না জানে। গণভোট হবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। গণভোট আগে হলে সংসদ নির্বাচন সনদের ভিত্তিতে হবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। পিআর হবে কিনা অনিশ্চিত।

নির্বাচনকে ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতার কথা এখন ক্ষমতাসীনরাই কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলছে। নির্বাচন হলে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কিনা সেটাও ভালো বলা যাচ্ছে না। বড় পার্টিগুলো, যে নির্বাচিত হবে, বিশেষত বিএনপি নির্বাচিত হলে তাদের মৌলিক দ্বিমতগুলো তারা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত।

বুর্জোয়া দলগুলো একেক প্রশ্নে একেক কথা বলছে। সব ব্যাঙ এক পাল্লায় মোটেই উঠছে না। কোন্দল দৃশ্যমান। এর সুযোগ অবশ্যই নিতে পারে “অসাংবিধানিক” সরকার। পতিত আওয়ামী লীগ তো বটেই। আর তাতে গোপন হাত/মদদ বহু সাংবিধানিক নিবন্ধিত দলেরও থাকতে পারে। চক্রান্তের কথা বড় দলগুলো সবাই বলছে। কার্যত অনেকেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

এসব হচ্ছে কেন? কারণ, ’২৪-এ কোনো বিপ্লব ঘটেনি। শুধু তাই নয়, ৮ আগস্ট অভ্যুত্থানের কোনো সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর জন্য বুর্জোয়া দলগুলো ও তার সাথে যোগসাজশে তৃতীয় শক্তিতো অবশ্যই কাজ করেছে। কিন্তু এ বিপর্যয় ও বিশ্বাসঘাতকতা ডেকে এনেছে অভ্যুত্থানের নাম করে ছাত্র-নেতাদের একটা অংশও, যারা এখন এনসিপি-কে চালাচ্ছে, আর বড় বড় বিপ্লবী কথা-বার্তা বলছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর পতিত ফ্যাসিবাদ ও নব্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণের একটি বিপ্লবী গণসরকার গঠন না করে তারা বুর্জোয়া রাজনীতির অংশ হয়েছে। এর পুরস্কার স্বরূপ তারা কিংস পার্টি করার সুবিধা ভোগ করলেও পরে তৃতীয় শক্তির একাংশ তাদের উপর আস্থা রাখতে না পেরে অন্য শক্তিগুলোর দিকে মোচড় দিয়েছে। ফলে তারা এখন বিরোধী সুরে কথা বলছে, আবার ক্ষমতার দুধ-মধুও খাচ্ছে। তারা শাসকশ্রেণির অংশ হিসেবেই কাজ করে চলার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। বুর্জোয়া এসব ষড়যন্ত্র, দরাদরি, কোন্দল, ষড়যন্ত্র জনগণকে সম্পূর্ণ পাশ কাটাতে হবে। তাদের সংগ্রাম করতে হবে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ, বড় বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ও আধা-সামন্তবাদী ব্যবস্থা বিরোধী একটি প্রকৃত গণ-বিপ্লবের জন্য।  

– ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

সনদ ও গণভোট : ‘জাতীয় ঐকমত্য’, নাকি বুর্জোয়া দরাদরি, কোন্দল ও ভাঙন

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
বৃহঃস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫  |  অনলাইন সংস্করণ

ভূমিকা 

ওরা একে বলছে “জাতীয় জুলাই সনদ”। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট স্মরণীয় হাসিনা-বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের কারণে। এ অভ্যুত্থানের সুদীর্ঘ ১৫ মাস পরে এই সনদটি ঘোষিত হলো ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর। ড.ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার” রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন” গঠন করেছিল ফেব্রুয়ারিতে। গঠনের পর এ কমিশন নয় মাস পর এ সনদটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর গ্রহণ করে তা প্রকাশ করেছে।

এটি জাতীয় ঐকমত্য নয়

ক্ষমতাসীন তৃতীয় শক্তি, বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল ও তাদের লেজুড় ছোটো দলগুলো দাবি করছে এটি জাতীয় ঐকমত্য। কিন্তু খোলা চোখেই দেখা যাবে যে, এটি সমগ্র জাতির ঐকমত্য নয়। প্রথমত, এ তথাকথিত ঐকমত্যের আলোচনায় ৩৮টি দল/জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৩২টি দল, শেষে ৩০টি দল/জোট অংশ নেয়। কীভাবে দাবি করা যায় যে, এ ধরনের ৩০টি দল সমগ্র জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে? গুটিকয় বড় বুর্জোয়া দল ছাড়া বাকী প্রায় বিশ/পঁচিশটি দল/জোটের কার্যত কোনো গণ-ভিত্তি বা সংগঠনই নেই। তাদের নামও অংশগ্রহণকারী অনেকে বলতে পারবেন না। বিশেষত, জনগণের সবচেয়ে সংখ্যাগুরু অংশ শ্রমিক ও কৃষক, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ আদিবাসী, নারী, ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী– এদের শ্রেণি/পেশা/সম্প্রদায়গত কোনো প্রতিনিধিত্বই এই দরাদরিতে ছিল না। জাতি কি শুধু কিছু বুর্জোয়া দল, কিছু এনজিও আর বুদ্ধিজীবী নেতারা?

দ্বিতীয়ত, অংশগ্রহণকারী বাম নামধারী দলগুলোর একাংশ (সিপিবি, বাসদসহ ৪টি দল) তাদের নীতিগত কারণে (রাজনৈতিক) শেষ পর্যন্ত এতে স্বাক্ষর করেনি। এ পার্টিগুলো বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী, তাদের অনুসারী বুদ্ধিজীবী ও জনগণের বেশ কিছু অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।

তৃতীয়ত, তৃতীয় শক্তির একাংশের আশীর্বাদধন্য কিংস পার্টি এনসিপিও স্বাক্ষর করেনি, সনদের আইনগত ভিত্তি এতে না থাকায়। অবশ্য তারা বলছে সনদের সাথে তারা একমত।

চতুর্থত, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা স্বাক্ষর করেছে তাদের মাঝে মৌলিক কিছু জায়গায় গুরুতর দ্বিমত রয়েছে, যাতে তারা “নোট অব ডিসেন্ট” দিয়েছে। প্রধান বুর্জোয়া পার্টি বিএনপি এ ধরনের সবচেয়ে বেশি দ্বিমত জানিয়েছে। পঞ্চমত, হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হলেও আওয়ামী রাজনীতির অনুগত (বুঝে বা না বুঝে) বহু জনগণ দেশে রয়েছেন। চলমান বুর্জোয়া রাজনীতি তাদেরকে বাতিল করতে পারে না, কারণ, জুলাই-আগস্টে কোনো বিপ্লব ঘটেনি, ক্ষমতাসীনরাও এসব পার্টিকে এখনো পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেনি। অথচ তাদের ও তাদের মিত্র (যেমন জাতীয় পার্টি)-দেরকে আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হলেও জাতীয় পার্টি ও অন্য আওয়ামী মিত্র পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে সেটাও করা হয়নি। তাহলে তাদেরকে বাইরে রেখে বুর্জোয়া অর্থেও “জাতীয় ঐকমত্য” হয় কী করে?

এসব সত্ত্বেও একে বলা হচ্ছে “জাতীয় ঐকমত্য”। এটা কি এদের মূর্খতা, না জনগণের সাথে প্রতারণা?

সনদ দলিলের কিছু পরিচিতি 

দলিলটিতে মোট ৫টি অধ্যায় রয়েছে, আর শেষে রয়েছে স্বাক্ষরকারীদের অঙ্গীকারনামা। প্রথম চারটি ছোটো পরিচিতিমূলক ও ভূমিকা সম্বলিত অধ্যায় বাদে প্রধান ও বিস্তৃত অধ্যায়টির শিরোনাম হলো “ঐকমত্যে উপনীত হওয়া বিষয়সমূহ”। অধ্যায়ের এমন শিরোনামও প্রতারণামূলক। কারণ, এতে মোট ১৩টি উপ-অধ্যায়ের মোট ৮৪টি ধারায় অনেক ঐকমত্য ছাড়াও বহু বিষয়ে বিভিন্ন পার্টির খুচরা ও গুরুতর ভিন্নমতও রয়েছে, যা নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে।

যে মোট ৮৪টি ধারা এখানে উত্থাপিত হয়েছে তাতে ১নং থেকে ৮নং ধারাগুলো বাদে বাকী সবই প্রায় শাসকদের শাসন-ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত পরিবর্তনের বিষয়।

এসব ধারার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তার অধীনে নির্বাচন তথা নির্বাচনি ব্যবস্থা, বুর্জোয়া নারীদের প্রচলিত রাষ্ট্র-ক্ষমতায় ভাগ বাড়ানো, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া ক্ষমতা হ্রাস, উচ্চকক্ষ ও তাতে পিআর– ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব সংস্কারের উপরও অনেক কথা নিশ্চয়ই বলা যায়। কিন্তু সেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এসব নিয়েই বুর্জোয়া দলগুলো ও তৃতীয় শক্তির প্রতিনিধিরা সভার পর সভা করেছে (প্রথম পর্বে ৪৭টি ও দ্বিতীয় পর্বে আরো কয়েকটি), তর্ক করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তারপরও সব প্রশ্নে ঐক্য করতে পারেনি। ক্ষমতার কেন্দ্রে কিংস পার্টিটিকে এখন কিছুটা প্রান্তিক করে দেয়ায় তারা প্রায়ই গোস্বা করছে, তারা সনদ-অনুষ্ঠানও বর্জন করেছে। স্পষ্টতই তাদের নেতৃত্বে ও মদদে এমন একটি রাষ্ট্রীয় “পবিত্র” অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য জুলাই-যোদ্ধা নামে কিছু মানুষকে উস্কে দেয়ার কাজও তারা করেছে। পরে অবশ্য তাদেরকে অন্য সবাই বাবা-গো সোনা-গো বলে স্বাক্ষরে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাহোক, বুর্জোয়া শাসনের পদ্ধতিগত বিষয়ে বেশি কথা না বাড়িয়ে সনদের প্রথমে উল্লেখিত সাংবিধানিক সংস্কারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক প্রশ্নেই আমরা কিছুটা আলোচনা করবো। কারণ, এটাই, কিছুটা হলেও, এত সব আয়োজনের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সনদ হলো বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির “তৃতীয় শক্তি”র রাজনীতি ও আপস-ফর্মূলা

 বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির হাসিনা-বিরোধী অংশগুলোর আপাত ঐক্য ও কোন্দলের দলিল   

একে বলা হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য, ইউনূস বলেছেন এটা জাতি/দেশকে বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এনে দিয়েছে, শুধু দেশ নয় সারা পৃথিবীর জন্য এটা এক অসাধারণ বিষয়– ইত্যাদি। বাস্তবে দেখা যাক এটা কী? এত ঢাক-ঢোল পেটানো একটি সনদ, যাকে তৈরি করার জন্য একজন বাঙালি চামড়ার আমেরিকান নাগরিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে উড়িয়ে আনা হয়েছে, তাতে শ্রমিকের জন্য কী “নতুন বন্দোবস্ত” রয়েছে? কৃষকের জন্য? আদিবাসীর জন্য? নারীদের জন্য?

এতে কি সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে একটিমাত্র শব্দও রয়েছে? ভারতের বিরুদ্ধে এত-যে জেহাদ, কোরানের শাসন-পন্থিরা সহ, তথাকথিত জেন-জি’র তরুণ প্রজন্মের যারা এই সনদের বড় উদ্যোক্তা তারাসহ, সেই ভারত সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?

বুর্জোয়া দল বাদ দিলাম, তথাকথিত বাম দলগুলো, যাদের একাংশ “নতুন বন্দোবস্ত”-র নামে হরদম টিভি চ্যানেলগুলো গরম করে রাখে, তারা কি এসব বিষয় সনদে আনার জন্য কোনো সংগ্রাম করেছে?

এসব কিছুই নেই। আগেই আমরা বলেছি, বিভিন্ন শ্রেণি/পেশা/সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিকেই এখানে ডাকা হয়নি। ডাকা যদি হতোও, তাতেও তারা এসব জনগণের বুর্জোয়া প্রতিনিধিই হতো। কিন্তু তাও-তো ডাকা হয়নি।

যে তরুণ শিক্ষার্থী ও তথাকথিত জেন-জিদের প্রতিনিধি বলে দাবি করা নতুন দলটি জন্ম নিয়েছে “বৈষম্যবিরোধী” ছাত্র-আন্দোলনের একাংশ থেকে, তারা কি সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রে বাদ দিন, শুধুমাত্র শিক্ষায় বৈষম্য অবসানের জন্য কোনো বিষয় এনেছে এখানে?

নারীদের মৌলিক সমস্যার উপর কোনো কথা না বলে, বা পুরোনো “বন্দোবস্ত” রেখে দিয়ে তারা কিছু বেশি সংখ্যায় বুর্জোয়া নারীদের এমপি হবার পথ খোলাসা করেছে মাত্র। এটা নারী এনজিও কর্মকর্তাদের জন্য একটি সুবাতাস বটে, কিন্তু আপামর নারীদের ক্ষেত্রে এর কী ফল থাকতে পারে?

এসবের মূল কারণ হলো, এ দলিল পেশ করেছে ও পাশ করিয়েছে বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির তথাকথিত তৃতীয় শক্তিটি, যারা অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করেছে, অভ্যুত্থানে পেটি-বুর্জোয়া ও বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বদের ষড়যন্ত্র ও দেউলিয়াপনার কারণে। যেহেতু তারা দীর্ঘবছর ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না বুঝে গেছে, তাই তারা তাদের কিছু স্বাস্থ্য-বটিকা বুর্জোয়া রাজনীতিকে খাইয়ে দেবার চেষ্টাতেই এ সনদটি করেছে।  এটা দিয়ে নাকি ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদ প্রতিহত হবে। কোন বোকার স্বর্গে তারা বাস করছে? এ সনদ তৈরির কারিগরদের মধ্যেই তো রয়েছে এদেশের শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিস্ট ’৭১-এর রাজাকারের উত্তরসূরী জামাতসহ ধর্মবাদী দলসমূহ। রয়েছে বিরাজনীতিকরণের কুশিলব তৃতীয় শক্তির গোপন ও প্রকাশ্য ভূমিকা। কীভাবে এটা ফ্যাসিবাদকে ঠেকাবে?

সংবিধানের মূল নীতি 

সনদে প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হলো সাংবিধানিক সংস্কার, বিশেষত তার মূল নীতি বিষয়ক পরিবর্তন। সংবিধানের মৌল নীতি আগে ছিল (’৭২-এর সংবিধানে) চারটিÑ যথা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এটা যা-ও কিছুটা ছিল সেটাও উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মৌলিক এ কারণেই ৪টি বামপন্থি দল সনদে স্বাক্ষর করেনি।  আমরা ’৭২-সংবিধানকে সমর্থন করি না, তাই এই চার মূল নীতির কাগুজে উল্লেখ প্রশ্নে আমাদের কোনো প্রেম নেই। কিন্তু এটা তো দেখানো অন্যায় নয় যে, চলমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে তার মূল নীতিকে এরা বাতিল করে কোন ক্ষমতায়? এই স্ববিরোধকে ও প্রতারণামূলক কাজকে ন্যায্য করার জন্য তারা গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ– ইত্যাদির সুর তুলেছে। আর এসব নিয়ে তাদের মাঝে পুনরায় কোন্দল ও খেয়োখেয়ি বেধে গেছে।

’৭২-সংবিধানের মূলনীতি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কী দিয়ে? তারা বলছে “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার”। এসব কথা তারা কোথায় পেয়েছে? পেয়েছে ’৭১-সালে ১০ এপ্রিল গঠিত তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের ভাষণ থেকে। এদেশে অনেকেই রয়েছেন যারা শেখ মুজিবকে বাতিল করতে গিয়ে তাজউদ্দিনকে তুলে ধরেন; ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানকে ও ’৭২-সংবিধানকে বাতিল করতে চান তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। কিন্তু এটা-যে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ভারত-আওয়ামী বয়ানেরই একটি রকমফের সেটা তারা মাটিচাপা দেন। দেশে বহু আন্তরিক বামপন্থি, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীও এমন বয়ান দেন।

প্রথমত, উপরোক্ত নীতি ’৭১-মুক্তিযুদ্ধ কালে ভারতে গঠিত, ভারত দ্বারা সৃষ্ট, আওয়ামী প্রবাসী সরকারেরই একটা ভাষণ, যা তাজউদ্দিন আগরতলায় সরকার গঠনের পর তার ১১ এপ্রিলের ভাষণে দিয়েছিলেন। আমরা ’৭২-সংবিধানকে উচ্চে তুলতে চাই না, কিন্তু এটা তো সত্য যে এ সংবিধান রচনা করেছিল অন্ততপক্ষে বাংলাদেশি লোকেরা এ দেশে বসেই। অন্যদিকে তাজউদ্দিনের ভাষণটি দেয়া হয়েছিল ভারতের মদদে গঠিত ভারতের প্রত্যক্ষ পরামর্শে প্রত্যক্ষভাবে ভারত-পরিচালিত প্রবাসী সরকারের নামে ভারতের বেতার থেকে। একে মহিমান্বিত করার অর্থ হলো ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের উঠতি বুর্জোয়ার ভারত-নতজানু নীতিকেই মেনে নেয়া।

দ্বিতীয়ত, এসব নীতি একেবারেই বিমূর্ত। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা ছিল অষ্টাদশ শতকে মহান ফরাসী বিপ্লবের স্লোগান। সেটা তখন বুর্জোয়া বিপ্লবকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। যদিও পরবর্তী একশ বছরের কম সময়ের মধ্যেই এসবের ফঁাকা চরিত্র প্রমাণিত হয় এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র বিশ্ব-রাজনীতির প্রগতিশীল চরিত্রকে প্রকাশ করতে থাকে। সনদে যা এসেছে তা পুরোনো ও বাতিল হয়ে যাওয়া বুর্জোয়া বিমূর্ত বাক্যবিন্যাস মাত্র।

’৭২-এর সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটির সংযোজন মুজিব-আওয়ামী লীগের কোনো সমাজতন্ত্র প্রেম থেকে ঘটেনি, ঘটেছিল তৎকালে সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার মুখে জনগণকে প্রতারণা করার জন্য। কিন্তু সমাজতন্ত্র শব্দটি সাম্যের চেয়ে অনেক বেশি মূর্ত। তাকে বাদ করে সাম্য....... যোগ করা হলো প্রতারণা তো বটেই, ঐ সংবিধানের থেকেও দু’পা পিছিয়ে যাওয়া। একই কথা বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে। শব্দটি বাংলায় খুব যথার্থ না হলেও সেটা একটা প্রগতিশীলতার স্বীকৃতি বটে, যদিও এটাও পরে আওয়ামীদের একটা শয়তানি প্রতারণায় পরিণত হয়। তার বদলে আনা হয়েছে “ধর্মীয় স্বাধীনতা”। ধর্মীয় স্বাধীনতা জনগণের থাকতে হবে, কিন্তু এটা দ্বারা রাষ্ট্র যে ধর্ম-বিযুক্ত হবে তাকে আরো বেশি অস্পষ্ট করা হয়। সেকারণেই দেখা যাবে এতবড় ঢাক-ঢোলের সংস্কারে সংবিধানে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদ কর্তৃক ধর্ম ব্যবহার করার অপস্বার্থে যুক্ত করা “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম”কে স্পর্শ পর্যন্ত করা হয়নি। এটা-তো এরশাদ-হাসিনা-খালেদা-জামাত-ধর্মবাদী স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্টদের একই বন্দোবস্তের পথে চলা।

আগে বলা হয়েছিল দেশের জনগণ জাতি হিসেবে “বাঙালি”। এই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাতিল করাটা ভালো। কিন্তু এর বদলে বিভিন্ন জাতির জনগণের জাতি পরিচয়টিকেই উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা নতুন ধরনের প্রতারণা ব্যতীত আর কিছু নয়।

অথচ এর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা রূপে আগের মতোই বাংলা-কে রাখা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অন্য জাতিগুলোর ভাষাগুলোকে অমর্যাদা করা হয়েছে। একটি একক রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা হাসিনার মতোই উগ্র-জাতীয়তাবাদের পথ করে দেয়। ইতিহাস বর্ণনায় ’৪৭-সালের পাকিস্তান সৃষ্টিকে কূট-কৌশলে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে, আবার ’৭১-এর আওয়ামী-ভারতের মুক্তিযুদ্ধ বয়ানকে রাখা হয়েছে। একদিকে এটা ঘোরতর স্ববিরোধিতা, অন্যদিকে দেশের আধুনিক ইতিহাসে বড় বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের একই রাজনৈতিক অবস্থানকে কিছু পরিবর্তিত রূপে তুলে ধরা। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস বর্ণনায় আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হত্যা-নিপীড়নকে বিরোধিতার আড়ালে চরম পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল দাবির ভিত্তিতে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের সমাবেশকে তুলে ধরা ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদের পথ করে দেয়ার নিন্দনীয় সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়।   গণভোট প্রশ্নে জনগণের সাথে প্রতারণা আগেই আমরা বলেছি যে, সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নে নিজেদের স্ববিরোধিতাকে আড়াল করার জন্য সনদকে গণভোটে দেয়ার একটি প্রস্তাব আলোচনা হচ্ছে। যদিও সেটা সংসদ নির্বাচনের আগে হবে না একসাথে হবে তা নিয়ে কোন্দল চলমান। যার সুযোগ নিতে চাচ্ছে তৃতীয় শক্তির সেই অংশ যারা নির্বাচন চাচ্ছে না এবং নিজেদের ফাও ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। গণভোট হয়ে থাকে একটিমাত্র প্রশ্নে, যাকে জনগণ হ্যাঁ-না ভোট হিসেবে জানেন। সনদ একটিমাত্র বিষয় নয়। এতে ৮৪টি ধারা রয়েছে। বহু বিষয়ে প্রধান বুর্জোয়া পার্টি বিএনপিসহ অনেকের দ্বিমতও রয়েছে। কীভাবে এই জটিল বিষয়টিকে হ্যাঁ বা না ভোট দিয়ে জনগণ মতামত দেবেন? গুরুতর বিষয়টি হলো, চলমান সংবিধানে গণভোটের বিষয়টিই নেই। তাহলে কীভাবে সংবিধানকে যারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার শপথ নিয়েছে তাদের পক্ষে গণভোট করা সম্ভব? ধরলাম তারা জোড়াতালি দিয়েই চালাতে চায়। কিন্তু গণভোটে মোট ভোটারের অর্ধেকের কম ভোট পড়লে? যার সম্ভাবনা খুবই রয়েছে, কারণ জনগণের কোনো ঠ্যাকা পড়েনি এ জাতীয় ভোটে অংশ নেবার। অথবা প্রদত্ত ভোটের অধিকাংশ যদি ‘না’ ভোট পড়ে? তাহলে কি তারাই প্রমাণ করবে না যে, অভ্যুত্থানটি অন্যায় ছিল এবং জনগণ তার বিরুদ্ধে? এমন পদক্ষেপে যাবার পেছনে ষড়যন্ত্র থাকা কি অস্বাভাবিক?

যারা সনদে স্বাক্ষর করেছেন তারাই বা কীভাবে তাদের দ্বিমতগুলোকে বাস্তবায়ন করবেন?

 

সনদে নব্য-ফ্যাসিবাদের সুর 

সনদে যারা কিছু বিষয়ে দ্বিমত করেছেন তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু সনদের শেষে অঙ্গীকারনামায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, তারা এ সনদ “পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত” করবে। এটা তো ভিন্নমতকে স্বীকার করেও জোর করে তৃতীয় শক্তির মতামতকে গিলিয়ে দেয়া। বিএনপিসহ ডিসেন্ট দেয়া পার্টিগুলো কীভাবে এটা মেনে নেয়? তারা কি সজ্ঞানে ফ্যাসিবাদী নীতিকে স্বীকার করে নিচ্ছেন না?

আবার বলা হয়েছে সনদের কোনো বিষয়ে আপত্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। এর অর্থ হলো, ভিন্নমতকে অঙ্কুরেই মেরে ফেলা। এটাও কি নব্য-ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি নয়? একদিকে তারা বলছে জনগণের অভিপ্রায় হলো সবচেয়ে বড় আইন, অন্যদিকে বলছে জনগণ তার অভিপ্রায় নিয়ে আদালতে যেতে পারবে না। এটা বিচার চাওয়ার প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকারকেই পদদলিত করে।

বলা হয়েছে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সনদে উল্লিখিত নীতি/মতই প্রাধান্য পাবে। এটা কি সংবিধানের নামে আরেকটি প্রতারণা ও ফ্যাসিবাদী বক্তব্য নয়?

শেষ কথা 

নির্বাচন হবে কিনা তা অনিশ্চিত। কারণ, সবাই জানে ও অনেকেই বলছে যে, ষড়যন্ত্র চলছে। তৃতীয় শক্তির অনেকেই নির্বাচন চায় না। ড.ইউনূস যদিও জোর গলায় দেশে ও বিদেশে বলে চলেছেন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। যত অনিশ্চিত, তত জোর গলা। কে না জানে। গণভোট হবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। গণভোট আগে হলে সংসদ নির্বাচন সনদের ভিত্তিতে হবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। পিআর হবে কিনা অনিশ্চিত।

নির্বাচনকে ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতার কথা এখন ক্ষমতাসীনরাই কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলছে। নির্বাচন হলে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কিনা সেটাও ভালো বলা যাচ্ছে না। বড় পার্টিগুলো, যে নির্বাচিত হবে, বিশেষত বিএনপি নির্বাচিত হলে তাদের মৌলিক দ্বিমতগুলো তারা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত।

বুর্জোয়া দলগুলো একেক প্রশ্নে একেক কথা বলছে। সব ব্যাঙ এক পাল্লায় মোটেই উঠছে না। কোন্দল দৃশ্যমান। এর সুযোগ অবশ্যই নিতে পারে “অসাংবিধানিক” সরকার। পতিত আওয়ামী লীগ তো বটেই। আর তাতে গোপন হাত/মদদ বহু সাংবিধানিক নিবন্ধিত দলেরও থাকতে পারে। চক্রান্তের কথা বড় দলগুলো সবাই বলছে। কার্যত অনেকেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

এসব হচ্ছে কেন? কারণ, ’২৪-এ কোনো বিপ্লব ঘটেনি। শুধু তাই নয়, ৮ আগস্ট অভ্যুত্থানের কোনো সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর জন্য বুর্জোয়া দলগুলো ও তার সাথে যোগসাজশে তৃতীয় শক্তিতো অবশ্যই কাজ করেছে। কিন্তু এ বিপর্যয় ও বিশ্বাসঘাতকতা ডেকে এনেছে অভ্যুত্থানের নাম করে ছাত্র-নেতাদের একটা অংশও, যারা এখন এনসিপি-কে চালাচ্ছে, আর বড় বড় বিপ্লবী কথা-বার্তা বলছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর পতিত ফ্যাসিবাদ ও নব্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণের একটি বিপ্লবী গণসরকার গঠন না করে তারা বুর্জোয়া রাজনীতির অংশ হয়েছে। এর পুরস্কার স্বরূপ তারা কিংস পার্টি করার সুবিধা ভোগ করলেও পরে তৃতীয় শক্তির একাংশ তাদের উপর আস্থা রাখতে না পেরে অন্য শক্তিগুলোর দিকে মোচড় দিয়েছে। ফলে তারা এখন বিরোধী সুরে কথা বলছে, আবার ক্ষমতার দুধ-মধুও খাচ্ছে। তারা শাসকশ্রেণির অংশ হিসেবেই কাজ করে চলার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। বুর্জোয়া এসব ষড়যন্ত্র, দরাদরি, কোন্দল, ষড়যন্ত্র জনগণকে সম্পূর্ণ পাশ কাটাতে হবে। তাদের সংগ্রাম করতে হবে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ, বড় বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ও আধা-সামন্তবাদী ব্যবস্থা বিরোধী একটি প্রকৃত গণ-বিপ্লবের জন্য।  

– ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র